শক্তির নানা রূপের মাঝে তড়িৎ বা বিদ্যুৎ শক্তি। সবচেয়ে প্রয়োজনীয় একটি শক্তি, কারণ এটি দিয়ে আমরা আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে সবচেয়ে বেশি কাজ করতে পারি। বিদ্যুৎ বা তড়িৎ আলো জ্বালায়, পাখা চালায়, রেডিও, ফ্রিজ, টিভি বা কম্পিউটার চালায়। বিদ্যুতের সাহায্যে রান্না করা যায়। এর ব্যবহারকে ভালো করে বুঝতে হলে আমাদেরকে বিদ্যুৎ বা তড়িৎ সম্পর্কে ধারণা নিতে হবে। বিদ্যুৎ বা তড়িৎ সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা থাকলেই আমরা তড়িতের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করে এর অপচয় বন্ধ করার ক্ষেত্রে নিজেরা যত্নবান হতে পারব এবং অন্যদের সচেতন হতে সাহায্য করতে পারব।
এই অধ্যায় পাঠ শেষে আমরা
১২.১.১ তড়িৎ বর্তনীর প্রতীক
ইলেকট্রিক সার্কিট বা তড়িৎ বর্তনীর চিত্র বা নকশা আঁকার সুবিধার জন্য আমরা প্রত্যেকটি যন্ত্রের বা সংযোগের একটি প্রতীক চিহ্ন ব্যবহার করে থাকি। নিচের ছকে এ রকম কিছু যন্ত্রের বা সংযোগের প্রতীক চিহ্ন দেওয়া হলো।
১২.১.২ ব্যাটারির কার্যক্রম
আমরা সবাই আমাদের দৈনন্দিন জীবনে টর্চ লাইটে বা মোবাইল ফোনে ব্যাটারি সেল ব্যবহার করেছি। সাধারণত কথাবার্তায় একটি সেলের জন্যে ব্যাটারি শব্দটি ব্যবহার করলেও বিজ্ঞানের ভাষায় ব্যাটারি বলতে একাধিক কোষের (Cell) সমন্বয়কে বোঝানো হয়। একটি তড়িৎ ব্যাটারি বলে উল্লেখ করলেও প্রকৃতপক্ষে ব্যাটারি হলো একাধিক তড়িৎ কোষের সমন্বয়। ব্যাটারি সেলে ব্যবহারের জন্য তড়িৎ শক্তি জমা থাকে। চিত্র ১২,০২-এ একটি ব্যাটারির গঠন দেখানো হলো। ব্যাটারিতে সাধারণত তিনটি অংশ ইলেকট্রোলাইট অ্যানোড ক্যাথোড থাকে। একটি অ্যানোড, একটি ক্যাথোড এবং মাঝখানে ইলেকট্রোলাইট। ব্যাটারি সেলে রাসায়নিক বিক্রিয়ার অ্যানোড থেকে ইলেকট্রন সরিরে ক্যাথোডে জমা করা হয়। এর ফলে অ্যানোড এবং ক্যাথোডের মধ্যে তড়িৎ বিভব পার্থক্য তৈরি হয়। এ অবস্থার অ্যানোড এবং ক্যাথোডকে পরিবাহী তার দ্বারা সংযুক্ত করলে ক্যাথোডের ইলেকট্রনগুলো অ্যানোডে প্রবাহিত হতে থাকে। ইলেকট্রন প্রবাহের বিপরীত দিকে বিদ্যুৎ প্রবাহ ধরে নেওয়া হয়। তাই আমরা বলি অ্যানোড থেকে ক্যাথোডে বিদ্যুৎ প্রবাহ হচ্ছে। সাধারণ ব্যাটারি সেলের রাসায়নিক পদার্থ বিক্রিয়া করে খরচ হয়ে যাওয়ার পর সেটি অ্যানোড এবং ক্যাথোডে আর বিভব পার্থক্য সৃষ্টি করতে পারে না বলে বিদ্যুৎ প্রবাহ বন্ধ হয়ে যায়। আমরা মোবাইল টেলিফোনে যে ব্যাটারি ব্যবহার করি, সেগুলোর বিদ্যুৎ প্রবাহ তৈরির ক্ষমতা শেষ হয়ে যাবার পর নতুন করে চার্জ করিয়ে নেওয়া যায়, তখন ব্যাটারির রাসায়নিক পদার্থগুলো পুনরায় রাসায়নিক বিক্রিয়া করে বিদ্যুৎ তৈরি করার জন্য প্রস্তুত হয়।
১২.১.৩ ইলেকট্রিক সার্কিট বা তড়িৎ বর্তনী
আমাদর দৈনন্দিন জীবনে বিদ্যুৎ কীভাবে ব্যবহার করা হয়, সেটি বুঝতে হলে আমাদের ইলেকট্রিক সার্কিট বা তড়িৎ বর্তনী সম্পর্কে কিছু বিষয় জানতে হবে।
(ক) সিরিজে ব্যাটারি সেল: ব্যাটারি সেলকে সিরিজে (চিত্র ১২.০৩) লাগানো হলে ব্যাটারির বিভব যোগ হয়। অর্থাৎ একটি ব্যাটারি সেলে ১.৫ ভোল্ট হলে দুটি ব্যাটারি সেল দিয়ে ৩ ভোল্ট এবং তিনটি সেল দিয়ে ৪.৫ ভোল্ট পাওয়া সম্ভব।
খ) সমান্তরালে ব্যাটারি সেল: কয়েকটি সেল সমান্তরাল ভাবে (চিত্র ১২.০৪) লাগানো হলে তার বিভবের পরিবর্তন হয় না কিন্তু বেশি বিদ্যুৎ প্রবাহ করতে পারে কিংবা সার্কিটে বেশি সময় ধরে বিদ্যুৎ প্রবাহ করতে পারবে।
(গ) ধরা যাক আমরা ব্যাটারি দিয়ে কয়েকটি বাল্ব জ্বালাতে চাই। সেটি দুইভাবে করা সম্ভব, সিরিজ সার্কিট বা সিরিজ বর্তনী এবং সমান্তরাল সার্কিট বা সমান্তরাল বর্তনী ।
সিরিজ সার্কিটে (চিত্র ১২.০৫) একটি বাল্ব অনেক উজ্জ্বলভাবে জ্বলবে কিন্তু দুটি বা তিনটি বাল্ব লাগানো হলে বিদ্যুৎ প্রবাহ আনুপাতিকভাবে কমে যাবে বলে বাল্বগুলো অনুকূলভাবে জ্বলবে। সিরিজ সার্কিট একটি সুইচ লাগানো হলে সুইচ অফ করার সাথে সাথে সবগুলো বাল্ব একসাথে নিতে যাবে।
সমান্তরাল সার্কিট
সমান্তরাল সার্কিটে (চিত্র ১২.০৬) আমরা যতগুলো বাল্বই লাগাই না কেন, সবগুলোর দুই প্রান্তেই ব্যাটারি সেল থেকে সমান বিভব পার্থক্য প্রয়োগ করা হয় বলে সবগুলো বাল্বই সমান উজ্জ্বলতার জ্বলবে। এই সার্কিটে ইচ্ছে করলে প্রত্যেকটা বাধের জন্য আলাদা সুইচ লাগিয়ে প্রত্যেকটিকে আলাদাভাবে জ্বালানো এবং নেভানো সম্ভব।ব্যাটারি সেলের বিভব পার্থক্য সবসময় সমান থাকে বলে এগুলোকে ডিসি সাপ্লাই বলা হয়। আমাদের বাসায় যে বৈদ্যুতিক সাপ্লাই দেওয়া হয়, সেগুলো প্রতি সেকেন্ডে পঞ্চাশবার ধনাত্মক থেকে ঋণাত্মক বিভবে পরিবর্তিত হয় বলে সেগুলোকে এসি (Alternating Current) বলা হয়। একটি সাধারণ ব্যাটারি সেলে বিভব পার্থক্য মাত্র ১.৫। সেই তুলনায় আমাদের বাসার বিদ্যুৎ সাপ্লাই ২২০৮, এখানে উল্লেখ্য, বিদ্যুৎ প্রবাহ ৫ov থেকে বেশি হলে আমরা সেটি অনুভব করতে পারি এবং ২২০/ সাপ্লাই থেকে অনেক বড় ইলেকট্রিক শক খাওয়া সম্ভব এবং এই ইলেকট্রিক শকের কারণে শরীরের ভেতর দিয়ে যথেষ্ট বিদ্যুৎপ্রবাহ হলে মানুষের মৃত্যুও হতে পারে।
উদাহরণ: দুইটি দ্বিমুখী সুইচ ব্যবহার করে একটি সার্কিট ডিজাইন করো, যেটি ব্যবহার করে যেকোনো সুইচ দিয়েই একটি লাইট বাল্ব জ্বালানো কিংবা নেভানো সম্ভব।
১২.১.৪ বাড়িতে তড়িৎ বর্তনীর নকশা বা হাউজ ওয়ারিং
আমাদের প্রায় সবার বাড়িতেই বিদ্যুৎ-সংযোগ আছে। তোমরা কী জান, এই সংযোগ দেওয়ার পূর্বে বিদ্যুৎ সরবরাহ এবং বিতরণ করার জন্য একটা নকশা আঁকতে হয়? বাসায় বিদ্যুৎ বিতরণের একটি নকশা কেমন হতে পারে সেটি দেখানো হলো। বাড়িতে তড়িৎ-সংযোগের জন্য সিরিজ বর্তনী উপযোগী নয়। কারণ সুইচ অন করলে একই সাথে সংযুক্ত সব বাল্ব জ্বলে উঠবে, ফ্যান চলতে থাকবে। আবার অফ করলে সবগুলো একই সাথে অফ হয়ে যাবে। তার চাইতে বড় কথা, সবগুলো সিরিজে থাকলে কোনো বাল্ব বা ফ্যানই প্রয়োজনীয় ভোন্টেজ পাবে না, ভাগাভাগি হওয়ার কারণে ভোল্টেজ কমে যায়। মূলত বাসায় তড়িৎ-সংযোগ সমান্তরাল সংযোগব্যবস্থা মেনে করা হয়। এবার নিচে একটি হাউজ ওয়ারিংয়ের বিশদ চিত্র দেওয়া হলো (চিত্র ১২,০৭) এতে মেইন লাইনকে কীভাবে সংযোগ করে অন্যান্য উপাদান যেমন ফিউজ বা সার্কিট ব্রেকার, মেইন সুইচ, প্লাগ-সকেট, ডিস্ট্রিবিউশন বক্স এবং প্রয়োজনীয় বাতি বা পাখার সংযোগ দেওয়া হয় তা দেখানো হলো। বাসায় বিদ্যুৎ সরবরাহের প্রধান তার দুটির একটি হলো জীবন্ত (সাধারণত লাল রঙের) তার এবং অন্যটি নিরপেক্ষ তার (সাধারণত কালো রঙের) জীবন্ত তারে বিদ্যুৎ ভোল্টেজ (২২০ volt) থাকে। নিরপেক্ষ তারে কোনো তড়িৎ ভোল্টেজ থাকে না যেহেতু এটিকে মাটির সাথে সংযোগ করে দেওয়া হয়। এটি সার্কিট পূর্ণ করে বিদ্যুৎ প্রবাহ নিশ্চিত করে থাকে।মেইন তারটি ফিউজ বা সার্কিট ব্রেকার হয়ে মিটারে যায়। এর মাধ্যমে বাড়িতে কী পরিমাণ বিদ্যুৎ শক্তি খরচ হচ্ছে তা মিটারে লিপিবদ্ধ হয়। মিটার হতে তার দুটি মেইন সুইচে যায়। এই সুইচের সাহায্যে বাড়ির ভিতরের বিদ্যুৎ প্রবাহ প্রয়োজন হলে পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া।মেইন সুইচ থেকে তার দুটি ডিস্ট্রিবিউশন বক্সে যায়। সেখানে তার দুটি বিভিন্ন শাখা লাইনে বিভক্ত হয়ে যায়। প্রত্যেক শাখা লাইনের জন্য পৃথক পৃথক ফিউজ বা সার্কিট ব্রেকার থাকে। ছবিতে লাইটের জন্য ৫A, ফ্যানের জন্য ১০%, হিটারের জন্য ১৫A এবং প্লাগ সকেটের জন্য ৩০A সার্কিট ব্রেকার দেখানো হয়েছে। এদের প্রত্যেকটিতেই জীবন্ত তারের সংযোগ আছে এবং প্রত্যেকটি বাতি পাখার জন্য আলাদা আলাদা সুইচ সংযোগ দেওয়া আছে।বাড়িতে বৈদ্যুতিক ওয়ারিং দেওয়ার সময় বাতি বা পাওয়ার সুইচের যাবতীয় ফিউজ যেন জীবন্ত তারের সাথে সংযোগ হয়, সেদিকে বিশেষ করে নজর দিতে হবে। তাছাড়া সমস্ত তার পিভিসি বা যেকোনো অপরিবাহী পদার্থ দ্বারা মোড়ানো হতে হবে।বর্তমানে ওয়ারিং কেবলকে সাধারণত দেয়ালের প্লাস্টারের ভিতর দিয়ে টানা হয়। তাছাড়া সব ধরনের যন্ত্রপাতির জন্য ফিউজ সংযোগ নিশ্চিত করতে হবে। বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রপাতির (যেমন ফ্রিজ, টিভি ইত্যাদি) জন্য উপযোগী ফিউজ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়া প্রয়োজনীয় লোড নিতে পারে, সে ধরনের কেবল (Cable) ব্যবস্থা করতে হবে। তা না হলে বিদ্যুৎ প্রবাহের সময় তার উত্তপ্ত হয়ে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।
কোনো দ্রবণের মধ্যে বিদ্যুৎ বা তড়িৎ প্রবাহিত করে এর অণুগুলোকে ধনাত্মক ও ঋণাত্মক অংশে বিভক্ত করার পদ্ধতিকে তড়িৎ বিশ্লেষণ বলে।তড়িৎ প্রবাহ করে দ্রবণের যে দ্রবটিকে দুই ভাগে বিভক্ত বা বিশ্লেষণ করা হয়, তাকে তড়িৎ দ্রব বা তড়িৎ বিশ্লেষ্য পদার্থ বলে। আমরা আগে দেখেছি যে পরিবাহকের দুই পাশে ব্যাটারি সেল দিয়ে বিভব পার্থক্য তৈরি করলে পরিবাহকের মুক্ত ইলেকট্রনগুলো প্রবাহিত হয়, যেটাকে আমরা বিদ্যুৎ বা তড়িৎ প্রবাহ বলি। তড়িৎ বিশ্লেষণের সময় দ্রবণের ভেতর দিয়ে কীভাবে বিদ্যুৎ প্রবাহিত করা হবে? তড়িৎ বিশ্লেষণের বা ইলেকট্রোলাইসিসের সময় তড়িৎ দ্রবটি ধনাত্মক এবং ঋণাত্মক আয়নে বিভক্ত এবং ঋণাত্মক আয়নের প্রবাহ দিয়ে দ্রবণে বিদ্যুৎ প্রবাহ করা হয়। সকল এসিড, ক্ষার, কয়েকটি নিরপেক্ষ লবণ, এসিড মেশানো পানি ইত্যাদি তড়িৎ দ্রব বা তড়িৎ বিশ্লেষ্য পদার্থ। যেমন: H2SO4, HNO3, CuSO4, AgNO3, NaOH ইত্যাদি।আমরা জানি, স্বাভাবিক অবস্থায় পরমাণু বা অণুতে ইলেকট্রনের সংখ্যা নিউক্লিয়াসে অবস্থিত প্রোটনের সংখ্যার সমান হয়ে থাকে। কোনো অণু, পরমাণু বা যৌগমূলকে যদি স্বাভাবিক সংখ্যার ইলেকট্রনের চেয়ে কম বা বেশি ইলেকট্রন থাকে তাহলে তাকে আয়ন বলে। ইলেকট্রনের সংখ্যা স্বাভাবিকের চেয়ে কম হলে তাকে বলে ধনাত্মক আয়ন। আর যদি ইলেকট্রনের সংখ্যা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি হয় তাহলে তাকে বলে ঋণাত্মক আয়ন।তড়িৎ বিশ্লেষণের সময় তড়িৎ দ্রব ধনাত্মক এবং ঋণাত্মক আয়নে ভাগ হয়ে যায়। একটু আগে উল্লেখ করা তড়িৎ দ্রবগুলো নিচে দেখানো উপায়ে আয়নে বিভক্ত হয়ে যাবে:
→ 2H++ SO
HNO3 → H+ + NO3
CuSO4 AgNO3 → Ag+ + NO3®
→ Cu++ +
NaOH → Na+ + OH -
বিখ্যাত বিজ্ঞানী আরহেনিয়াস (Arrhenius) ১৮৮১ সালে তড়িৎ বিশ্লেষণের ব্যাখ্যা দেন। তিনি দেখিয়েছিলেন এসিড, ক্ষার বা লবণজাতীয় যৌগিক পদার্থকে তরলে প্রবীভূত করলে সেগুলো আয়নায়িত হয়ে সম-পরিমাণ ধনাত্মক ও ঋণাত্মক আধান বা চার্জযুক্ত আরনে ভাগ হয়ে যায়। আধানযুক্ত অবস্থায় আরনগুলোর রাসায়নিক ধর্ম প্রকাশ পার না। তবে চাহীন বা নিষ্ক্রিয় হলে এরা আবার রাসায়নিক বিক্রিয়ায় অংশ নিতে পারে। আয়নগুলো তরলের মধ্যে বিক্ষিপ্তভাবে ঘুরে বেড়ার। পরিবাহকে যেরকম ইলেকট্রন বিদ্যুৎ প্রবাহ করতে পারে, দ্রবণে এই আয়নগুলো সেরকম বিদ্যুৎ প্রবাহ করতে পারে। এখন এই তরলের মাঝে দুটি পরিবাহী দণ্ড বা তড়িৎদ্বার রেখে তরলের ভেতর যদি বিদ্যুৎ প্রবাহ করা হয় তাহলে ঋণাত্মক আয়নগুলো অ্যানোড ও ধনাত্মক আয়নগুলো ক্যাথোডের দিকে প্রবাহিত হতে থাকে। দুটি পরিবাহী দণ্ড বা ইলেকট্রোডের মধ্যে আয়নগুলোর এই বিপরীতমুখী প্রবাহের জন্য তড়িৎ প্রবাহ সৃষ্টি হয়।
১২.২.১ তুঁতের শ্রবণের তড়িৎ বিশ্লেষণের ব্যাখ্যা
ঋণাত্মক সালফেট আয়নগুলি ধণাত্মক অ্যানোডের দিকে যাচ্ছে
ধণাত্মক কপার আয়নগুলি ঋণাত্মক ক্যাথোডের দিকে যাচ্ছে
CuSO4
চিত্র ১২.০৮: তড়িৎ বিশ্লেষণ
ধরা যাক একটি কাচপাত্রে কিছু ভূত বা CuSO4 ও পানি নেওয়া হলো। CuSO4 পানিতে দ্রবীভূত হয়ে Cu ++ ও 504 - আয়নে বিশ্লিষ্ট হয় (চিত্র ১২.০৮)। এখন দ্রবণের মধ্যে দুটি তামার পাত ডুবিয়ে যি পাত দুটির সাথে একটি তড়িৎ কোষ সংযুক্ত করা হয় তাহলে আয়নের প্রবাহ শুরু হবে। Cu+ আরনগুলো ক্যাথোডে গিয়ে ক্যাথোড থেকে দুটি ইলেকট্রন গ্রহণ করে এবং নিশ্চয়িত তামায় পরিণত হয়ে ক্যাখোজে জমা হতে থাকবে। অন্যদিকে SO 4 - আয়নগুলো অ্যানোড দ্বারা আকৃষ্ট হরে সেখানে যাবে এবং সেখানে দুটি ইলেকট্রন ত্যাগ করে নিতষ্ঠিত হয়। নিস্তরিত SO 4 অ্যানোড থেকে Cu গ্রহণ করে CuSO4 উৎপন্ন করবে। এই CuSO4 আবার দ্রবণে দ্রবীভূত হবে বলে প্রবণের ঘনত্ব অপরিবর্তিত থাকবে।সুতরাং দেখা যাবে, প্রবল থেকে যে পরিমাণ Cu ক্যাথোডে জমা হচ্ছে, ঠিক সেই পরিমাণ Cu অ্যানোড থেকে দ্রবণে চলে আসছে । অর্থাৎ মোট ফল হচ্ছে অ্যানোডের ভর যতটুকু হ্রাস পায় ক্যাথোডের ভর ঠিক ততটুকই বৃদ্ধি পায়, আমাদের মনে হবে অ্যানোড থেকে Cu বুঝি ক্যাথোডে জমা হচ্ছে। কিন্তু ইলেকট্রোড দুটি তামার বদলে অন্য কোনো নিষ্ক্রিয় ধাতুর তৈরি হলে ক্যাথোডে ঠিকই আগের মতো তামার অণু জমা হবে কিন্তু CuSO4 অ্যানোড থেকে Cu নিয়ে CuSO4 হতে পারবে না বলে শুধুমাত্র বাড়তি ইলেকট্রন ত্যাগ করে পানির সাথে বিক্রিয়া করে H2SO4 উৎপন্ন করবে এবং O2 গ্যাস বুদবুদ আকারে বেরিয়ে আসতে থাকবে। ফলে আমরা দেখব দ্রবণের ঘনত্ব ধীরে ধীরে কমে আসছে।
১২.২.২ প্রাত্যহিক জীবনে তড়িৎ বিশ্লেষণের গুরুত্ব
১. তড়িৎ প্রলেপন (Electroplating) তড়িৎ বিশ্লেষণ করে একটি ধাতুর ওপর অন্য কোনো ধাতুর প্রলেপ দেওয়াকে তড়িৎ প্রলেপন বলে । সাধারণত কোনো কম দামি ধাতু (যেমন তামা, লোহা, ব্রোঞ্জ ইত্যাদি) দিয়ে তৈরি জিনিসকে জলবায়ু থেকে রক্ষা করার জন্য কিংবা সুন্দর দেখানোর জন্য সেগুলোর ওপর সোনা, রুপা, নিকেল এরকম মূল্যবান খাতুর প্রলেপ দেওয়া হয়। যে ধাতব বস্তুটিকে প্রলেপ দিতে হবে, সেটি খুব ভালোভাবে পরিষ্কার করে ধুয়ে একটি পাত্রে রাখতে হবে। এটি হবে ক্যাথোড ইলেকট্রোড। যে ধাতুর প্রলেপ দিতে হবে তাকে অ্যানোড করা হয়। তড়িৎ দ্রব হিসেবে যে ধাতুর প্রলেপ দিতে হবে, তার কোনো একটি লবণের দ্রবণ ব্যবহার করা হয়। এখন ব্যাটারি বা পাওয়ার সাপ্লাই ব্যবহার করে অ্যানোড থেকে ক্যাথোডে বিদ্যুৎ প্রবাহিত করলে ধাতুর তড়িৎ বিশ্লেষণের ফলে ক্যাথোডে রাখা ধাতব বস্তুর ওপর ধাতুর প্রলেপ পড়ে (চিত্র ১২.০৯)।
উদাহরণ হিসেবে ছবিতে কীভাবে রূপার প্রলেপন দিতে হবে সেটি দেখানো হয়েছে।
খাঁটি সিলভারের দন্ড, অ্যানোড আকারে রাখা হয়েছে
Ag-
NO3
AgNO3
যেই বস্তুকে
প্রলেপ দেয়া হবে সেটাকে ক্যাথোড আকার রাখা হয়েছে। এখানে সেটা একটা কাঁটা চামচ
চিত্র ১২.০৯ : তড়িৎ প্রলেপন
২. তড়িৎ মুদ্রণ (Electrotyping) তড়িৎ প্রলেপের একটি বিশেষ পদ্ধতি ব্যবহার করে হরফ, ব্লক মডেল ইত্যাদি তৈরি করাকে তড়িৎ মুদ্রণ বলে। তড়িৎ মুদ্রণের জন্য প্রথমে লেখাটি সাধারণ টাইপে মোমের ওপর ছাপ নেওয়া হয়। এর উপরে কিছু গ্রাফাইট গুঁড়ো ছড়িয়ে একে তড়িৎ পরিবাহী করা হয়। তারপর কপার সালফেট দ্রবণে এটি ক্যাথোড পাত হিসেবে ডুবানো হয় এবং একটি তামার পাতকে অ্যানোড হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এখন দ্রবণের মধ্যে তড়িৎ প্রবাহ চালালে মোমের ছাঁচের ওপর তামার প্রলেপ পড়বে। প্রলেপ খানিকটা পুরু হলে ছাঁচ থেকে ছাড়িয়ে ছাপার কাজে ব্যবহার করা হয়।
৩. ধাতু নিষ্কাশন ও শোধন (Extraction and purification of metals) খনি থেকে কোনো ধাতু সাধারণত বিশুদ্ধ অবস্থায় পাওয়া যায় না। এদের মধ্যে নানা ধাতুর মিশ্রণ থাকে যাকে আকরিক বলা হয়। তড়িৎ বিশ্লেষণের সাহায্যে আকরিক থেকে সহজে ধাতু নিষ্কাশন এবং শোধন করা যায়। যে আকরিক থেকে ধাতু নিষ্কাশন করতে হবে, সেটিকে অ্যানোড হিসেবে ব্যবহার করা হয়। যে ধাতু নিষ্কাশন করতে হবে, তার কোনো লবণের দ্রবণকে তড়িৎ দ্রব এবং তার ছোট একটি বিশুদ্ধ পাতকে ক্যাথোড হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এখন দ্রবণের মধ্য দিয়ে তড়িৎ প্রবাহ চালনা করলে আকরিক থেকে বিশুদ্ধ ধাতু নিষ্কাশিত হয়ে ক্যাথোডে সঞ্চিত হতে থাকবে।
পদার্থবিজ্ঞানের ভাষায় “কাজ” কথাটির একটি সুনির্দিষ্ট অর্থ আছে। কাজ এবং শক্তির একক হচ্ছে জুল। শক্তি প্রয়োগ করে কাজ করা যায় এবং কাজ করার হার অর্থাৎ একক সময়ে সম্পন্নকৃত কাজকে ক্ষমতা বলে। কোনো তড়িৎ যন্ত্র প্রতি সেকেন্ডে যে পরিমাণ তড়িৎ শক্তি ব্যয় করে কিংবা অন্য শক্তিতে (তাপ, আলো, যান্ত্রিক ইত্যাদি) রূপান্তরিত করে তাকে তড়িৎ ক্ষমতা বলে।
কিলোওয়াট
কোনো রোধ বা তড়িৎ যন্ত্রের দুই পাশের বিভব পার্থক্য এক ভোল্ট হলে যদি এর মধ্য দিয়ে এক অ্যাম্পিয়ার তড়িৎ প্রবাহিত হয়, তবে ঐ যন্ত্রের ক্ষমতা এক ওয়াট।
এক ওয়াট = ১ ভোল্ট × ১ অ্যাম্পিয়ার
যখন অনেক বেশি তড়িৎ ক্ষমতা ব্যবহৃত হয় তখন সেটাকে কিলোওয়াট বা মেগাওয়াটে প্রকাশ করা সুবিধাজনক ।
১ কিলোওয়াট = ১০০০ ওয়াট বা ১০৩ ওয়াট এবং ১ মেগা ওয়াট = ১০৬ ওয়াট।
কিলোওয়াট-ঘণ্টা
এক ওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন কোনো তড়িৎ যন্ত্রের মধ্যে দিয়ে এক ঘণ্টা ধরে তড়িৎ প্রবাহিত হলে যে পরিমাণ তড়িৎ শক্তি অন্য শক্তিতে রূপান্তরিত হয় (যেমন বাতি জ্বললে আলোক শক্তি বা পাখা ঘুরালে যান্ত্রিক শক্তি পাওয়া যায়) সেটি হচ্ছে এক ওয়াট-ঘণ্টা।
১ ওয়াট-ঘণ্টা
= ১ ওয়াট× ১ ঘণ্টা
অনেক সময় ওয়াট ঘণ্টার পরিবর্তে কিলোওয়াট ঘণ্টাও ব্যবহার করা হয়। আমরা ইচ্ছা করলে এক কিলোওয়াট ঘণ্টা কতটুকু শক্তি সেটাও বের করতে পারি।
বা, ১ কিলোওয়াট-ঘণ্টা = ১০০০ ওয়াট × ৩৬০০ সেকেন্ড
৩,৬০,০০০০ ওয়াট-সেকেন্ড
= ৩,৬০,০০০০ জুল
অর্থাৎ শক্তির এককে এটি ৩.৬ মেগা জুল।
আন্তর্জাতিকভাবে, তড়িৎ সরবরাহকে কিলোওয়াট-ঘণ্টা এককে পরিমাপ করা হয়। এই একককে বোর্ড অব ট্রেড (BOT) ইউনিট বা সংক্ষপে ইউনিট বলে। আমরা যে বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করি তা এই এককেই হিসাব করা হয় ।
তড়িৎ ক্ষমতার হিসাব
আমরা জানি, তড়িৎ সরবরাহ প্রতিষ্ঠান প্রতি মাসেই আমাদের বাড়ি বা প্রতিষ্ঠানের তড়িৎ খরচের একটি বিল পাঠায়। এই প্রতিষ্ঠান প্রতি ইউনিটের মূল্য ঠিক করে দেয়। সেই অনুযায়ী আমরা তড়িৎ বা বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করে থাকি। অর্থাৎ ব্যয়িত তড়িৎ শক্তির খরচ = ব্যয়িত তড়িৎ শক্তির একক প্রতি এককে খরচ। সব বৈদ্যুতিক যন্ত্রে (লাইট, ফ্যান, কম্পিউটার) কী পরিমাণ বিদ্যুৎ বা তড়িৎ ক্ষমতার প্রয়োজন হয়, সেটি উল্লেখ থাকে। কাজেই সেখান থেকে সহজেই আমরা ব্যয়িত শক্তি বের করতে পারব। আমরা ব্যয়িত শক্তি ইউনিট বা কিলোওয়াট বের করতে চাই। যদি একটি যন্ত্রের ক্ষমতা P ওয়াট হয় এবং সেটি আমরা t ঘণ্টা ব্যবহার করি তাহলে ব্যয়িত শক্তি E হচ্ছে:
E = P × t ওয়াট ঘন্টা
E = (P × t) / ১০০০ কিলোওয়াট ঘণ্টা (অথবা ইউনিট) সুতরাং কোনো যন্ত্রের ক্ষমতা জানলে সহজেই তড়িৎ শক্তি ব্যয়ের খরচ বের করতে পারি। যেমন ৬০ ওয়াটের একটি বাল্ব (P=৬০ W) প্রতিদিন ৫ ঘণ্টা করে ৩০ দিন (t=৩০×৫ hour) জ্বললে কত তড়িৎ শক্তি ব্যয় হবে?
আমরা জানি,
ব্যয়িত শক্তি = (P × t} / ১০০০ ইউনিট
- ৬০ × (৩০ x ৫)/১০০০ ইউনিট x
= ৯ ইউনিট
এখন যদি প্রতি ইউনিটের মূল্য ৮ টাকা হয়, তবে উচ্চ পরিমাণ বিদ্যুতের জন্য মোট ব্যয় হবে মোট তড়িৎ ব্যয় - ৯ x ৮ টাকা
= ৭২ টাকা
220V- 60W-এর অর্থ : তড়িৎ আলো পাওয়ার জন্য আমরা যে বাল্ব ব্যবহার করি তার গায়ে দুটি সংখ্যার পাশে V এবং W লেখা থাকে। কোনো বাঘের পারে ২২০ এবং ৬০w লেখা থাকলে বোঝা যায় ২২০ বিভব পার্থক্য বাল্বটিতে সংযুক্ত করলে বাল্বটি সবচেয়ে বেশি উজ্জ্বলভাবে জ্বলবে এবং তখন প্রতি সেকেন্ড ৬০ জুল বৈদ্যুতিক শক্তি আলো ও তাপশক্তিতে রূপান্তরিত হবে।এনার্জি সেভিং বান্ধের সুবিধা : এক সময় আমরা সাধারণ বার ব্যবহার করতাম। এই বারে একটি ধাতব ফিলামেন্টকে উত্তপ্ত করে আলো তৈরি হতো বলে প্রচুর তাপ শক্তির প্রয়োজন হতো। প্রযুক্তির কারণে এখন গৃহস্থালি কাজে ব্যবহার করার জন্য এনার্জি সেভিং বাল্ব সহজ লভ্য হয়ে গেছে। দুই ধরনের এনার্জি সেভিং বাল্ব রয়েছে সি.এফ.এল (Compact Fluroscent Lamp) এবং এল.ই.ডি (Light Emitting Diode) বাল্ব। এই এনার্জি সেভিং বাবে বিদ্যুৎ ২০-৮০% সাশ্রয় হতে পারে এবং সাধারণ বাল্বের তুলনায় এটি ৩ থেকে ২৫ গুণ বেশি সময় টিকে থাকতে পারে। একটি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে প্রতি পরিবারে যদি একটি করে সাধারণ বাল্বের পরিবর্তে এনার্জি সেভিং বাল্ব ব্যবহার করে, তবে যে পরিমাণ শক্তি বাঁচে তা দিয়ে প্রতিবছরে ৩০ লক্ষ পরিবারে তড়িৎ সংযোজন দেওয়া সম্ভব। আমরা যদি এনার্জি সেভিং বাল্ব ব্যবহার করে, শক্তির অপচয় কমাতে পারি, তবে জ্বালানির ওপরও আমাদের নির্ভরতা কমাতে পারি। কারণ, জীবাশ্ম জ্বালানি দিয়ে তড়িৎ উৎপাদনের ফলে পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়ে। এনার্জি সেভিং বাল্ব সাধারণ বাল্বের চেয়ে বেশি দিন টিকে। ফলে কমসংখ্যক বার পরিত্যয় হয়। যার কারণে ময়লা আবর্জনা ব্যবস্থানায়ও সুবিধা হয় পরিবেশের উপর চাপও কম পড়ে।
একক কাজ
কাজ: কেন সবার এনার্জি সেভিং বাল্ব ব্যবহার করা উচিত তার উপর একটি পোস্টার তৈরি করো।
১২.৪.১ আইপিএস এবং ইউপিএস
আমরা আমাদের দৈনন্দিন এবং কর্মজীবনে বিদ্যুতের উপর পুরোপুরি নির্ভরশীল এবং অনেক ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ সাপ্লাই বন্ধ হলে আমাদের সব কাজকর্ম বন্ধ হয়ে যায়। অনেক সময়েই তখন আমরা সাময়িকভাবে ভিন্ন বিদ্যুৎ সাপ্লাই ব্যবহার করি। ঘরের লাইট ফ্যানের জন্য এই ভিন্ন বিদ্যুৎ সাপ্লাই চালু করার জন্য দুই এক সেকেন্ড দেরি হলে আমাদের তেমন সমস্যা হয় না কিন্তু কম্পিউটার এবং এ ধরনের যন্ত্রপাতির বেলায় বিদ্যুৎ সাপ্লাই হঠাৎ করে বন্ধ হয়ে গেলে আমরা বড় ধরনের সমস্যায় পড়ে যাই। কম্পিউটারের তথ্য নষ্ট হতে পারে, এমন কী তার যন্ত্রপাতির ক্ষতি হতে পারে।
মূল বিদ্যুৎ প্রবাহ বন্ধ হওয়ার পর ভিন্ন সাপ্লাই দিয়ে বিদ্যুৎ প্রবাহ নিরবচ্ছিন্ন রাখার প্রক্রিয়াটি কত দ্রুত করা যায় তার উপর নির্ভর করে আইপিএস এবং ইউপিএস (চিত্র ১২.১০) তৈরি করা হয়েছে।
মূল এসি লাইন
ব্যাটারি চার্জার
আউটপুট
কন্ট্রোলার
ব্যাটারি
ইনভার্টার
চিত্র ১২-১০: আইপিএস / ইউপিএস
বাসার লাইট ফ্যান একটু খানি দেরি করে চালু হলেও ক্ষতি নেই বলে সেখানে আইপিএস ব্যবহার করা হয়। এটি চালু হতে এক দুই সেকেন্ড সমর নের এবং সাধারণত বাসার গৃহস্থালি কাজে অর্থাৎ লাইট ফ্যান চালু করার কাজে ব্যবহার করা হয়। কাজেই আইপিএস মোটামুটি বেশ অনেকক্ষণ যথেষ্ট পরিমাণ বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে পারে।ডেস্কটপ কম্পিউটার কিংবা এরকম সূক্ষ্ম যন্ত্রপাতির বেলায় ইউপিএস ব্যবহার করা হয়। কারণ বিদ্যুৎ প্রবাহ বন্ধ হবার দশ মিলিসেকেন্ডের ভেতর ইউপিএস বিদ্যুৎ প্রবাহ নিশ্চিত করতে পারে। কাজেই কম্পিউটারের বিদ্যুৎ প্রবাহ বন্ধ হয় না। ইউপিএস এর বিদ্যুৎ প্রবাহ করার ক্ষমতা কম, সাধারণত কম্পিউটারের কাজকর্মগুলো গুছিয়ে নিয়ে, প্রয়োজনীয় ফাইলগুলো সেভ করে, কম্পিউটারটি বন্ধ করে দেওয়ার সুযোগ পাওয়া যায়। ১২.১০ ছবিতে আইপিএস কিংবা ইউপিএসের কার্যপদ্ধতি দেখানো হলো। মূল বিদ্যুৎ প্রবাহ যখন চালু থাকে, তখন আইপিএস কিংবা ইউপিএসের ব্যাটারিগুলো চার্জ করা হতে থাকে। হঠাৎ করে মূল বিদ্যুৎ এবং সুইচটি মূল সাপ্লাই থেকে সরিয়ে ব্যাটারির সার্কিটের সাথে সংযুক্ত করে দেয়। ব্যাটারি থেকে ডিসি সাপ্লাই পাওয়া যায় বলে ইনভার্টার দিয়ে আগে এসি করে নিতে হয়। যখন মূল সাপ্লাই বন্ধ হয়ে যায় সেই মুহূর্তে কন্ট্রোল সার্কিট ইনভার্টারের সার্কিটও চালু করে দেয়।
১২.৪.২ তড়িতের সিস্টেম লস
আমরা জানি, দেশের বিভিন্ন স্থানে অবস্থিত পাওয়ার প্লান্টগুলোতে বিদ্যুৎ শক্তি উৎপাদন করে। এই বিদ্যুৎকে প্রয়োজন অনুসারে বিভিন্ন এলাকায় পাঠাতে হয়। বিদ্যুৎ বিতরণ করার জন্য প্রথমে বিভিন্ন এলাকার সাব-স্টেশনে পাঠানো হয়। সাব-স্টেশন থেকে বিদ্যুৎ বিতরণ-ব্যবস্থা ব্যবহার করে বিদ্যুৎ শক্তিকে একেবারে গ্রাহক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়।
বিদ্যুৎ শক্তিকে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় বিতরণ করার জন্য যে পরিবাহী তার ব্যবহার করা হয়, কম হলেও তাদের এক ধরনের রোধ থাকে। একটা রোধের (R) ভেতর দিয়ে বিদ্যুৎ প্রবাহ (1) হলে সবসময়েই (I2R) তাপ উৎপন্ন হয় এবং সেটি বিদ্যুৎ শক্তির লস বা ক্ষয়। এই লসকে বলা হয় সিস্টেম লস। তোমরা এর মাঝে জেনে গেছ যে একটা নির্দিষ্ট বিদ্যুৎ শক্তির জন্য যদি উচ্চ ভোল্টেজ বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয় তাহলে রোধজনিত তাপশক্তি হিসেবে লস কমে যায়। সে জন্যে বিদ্যুৎকেন্দ্রে যে বিদ্যুৎ শক্তি উৎপাদন করা হয় সেটিকে স্টেপ আপ ট্রান্সফর্মার দিয়ে উচ্চ ভোল্টেজে রূপান্তর করা হয়। গ্রাহকদের ব্যবহারের জন্য বিদ্যুৎ শক্তিকে বিতরণ করার আগে স্টেপ ডাউন ট্রান্সফর্মার ব্যবহার করে সেটিকে আবার ব্যবহারযোগ্য ভোল্টেজে নামিয়ে আনা হয়।
১২.৪.৩ লোড শেডিং
প্রত্যেকটি বিদ্যুৎকেন্দ্রে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ বিদ্যুৎশক্তি উৎপাদন করে এবং সবগুলো বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদিত বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যোগ হয়। আগেই বলা হয়েছে— এই বিদ্যুৎ স্থানীয় সাব-স্টেশন (বিদ্যুৎ উপকেন্দ্র)— এর মাধ্যমে গ্রাহকদের মাঝে বিতরণ করা হয়। বিভিন্ন এলাকার চাহিদা অনুযায়ী জাতীয় গ্রিড বিদ্যুৎ সরবরাহ করে। কোনো এলাকায় বিদ্যুতের চাহিদা যদি উৎপাদন থেকে বেশি হয়, তাহলে স্বাভাবিকভাবেই সেখানে প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে পারে না। তখন বাধ্য হয়ে সাব-স্টেশনগুলো এক এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করার জন্য অন্য একটি এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রাখতে বাধ্য হয়। এই প্রক্রিয়াটার নাম লোড শেডিং। সাব-স্টেশন যখন আবার প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ সরবরাহ পায় তখন সেই এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু করে। যদি একনাগাড়ে কয়েক ঘণ্টা লোডশেডিং করতে হয়, তখন গ্রাহক পর্যায়ে লোডশেডিংকে সহনীয় করার জন্য কর্তৃপক্ষ চক্রাকারে বিভিন্ন জায়গা আলাদা আলাদা সময়ে লোডশেডিং করে থাকে।
একটি দেশের উন্নয়নের সাথে শক্তির ব্যবহারের খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। সত্যি কথা বলতে কী, একটি দেশ কতটুকু উন্নত, সেটি বোঝার প্রথম মাপকাঠি হিসেবে শক্তির ব্যবহারকে বিবেচনা করা যেতে পারে। আমাদের দেশের উন্নয়নের জন্য আমাদের সবার প্রথম শিক্ষার দিকে নজর দেয়া উচিত। এই দেশে বিপুলসংখ্যক ছেলেমেয়ে স্কুল-কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করে। তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো ভালোভাবে চালানোর জন্য সেখানে প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে হয়। তাদের পড়াশোনা করার জন্য রাতে আলোর দরকার হয় এবং বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করা না হলে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া ক্ষতিগ্রস্ত হয়। উচ্চশিক্ষার বেলায় ল্যাবরেটরি ব্যবহার করতে হয়, কম্পিউটার এবং নেটওয়ার্ককে সচল রাখতে হয় যার জন্য বিদ্যুৎ সরবরাহের কোনো বিকল্প নেই।আমাদের দেশের অর্থনীতিতে কৃষি খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। দেশটি ছোট বলে কৃষি উপযোগী ভূমির পরিমাণ কম এবং সেটি আরো কমে আসছে। এই কৃষিভূমিতে দুই বা ততোধিক ফসল ফলিয়ে আমাদের দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। এ কারণে শুধু প্রাকৃতিক কৃষির উপর অপেক্ষা না করে কৃষিজমিতে পানি সেচের ব্যবস্থা করতে হয় এবং শক্তির সরবরাহ ছাড়া সেটি কোনোভাবে সম্ভব নয়। পানি সেচের জন্যে পাম্প চালাতে বিদ্যুৎ কিংবা জ্বালানির প্রয়োজন হয়। চাষাবাদের জন্য সারের প্রয়োজন হয় এবং সার কারখানায় বিদ্যুৎ এবং গ্যাস সরবরাহ ছাড়া প্রয়োজনীয় উৎপাদন সম্ভব নয়। জমি চাষ করার জন্য এবং ফসলকে প্রক্রিয়া করার জন্য ট্রাক্টর ব্যবহার করা হয় এবং ট্রাক্টরের জন্য প্রয়োজনীয় জ্বালানির সরবরাহ থাকতে হবে।
কৃষির পর স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার জন্য শক্তির সরবরাহ প্রয়োজন। সুস্থ দেহে থাকার জন্য একটি স্বাস্থ্যকর পরিবেশ দরকার হয়। বাংলাদেশের মতো ঘনবসতিপূর্ণ এলাকার স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ তৈরি এবং বর্জ্য প্রক্রিয়া করার জন্য শক্তির দরকার হয়। বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করার জন্যে শক্তির দরকার হয়। চিকিৎসা সেবার জন্যে হাসপাতালে এক মুহূর্তের জন্য বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ থাকতে পারে না।শিক্ষা, কৃষি এবং স্বাস্থ্য ছাড়াও দেশের যোগাযোগব্যবস্থা, শিল্প, কলকারখানা এবং অবকাঠামো গড়ে তোলার জন্য শক্তির দরকার হয়। সে কারণে সঠিক পরিকল্পনা করে দেশে বিদ্যুৎকেন্দ্র গড়ে তুলতে হবে যেন ভবিষ্যতে শক্তির ঘাটতি না হয়। শক্তির অপচয় বন্ধ করতে হবে এবং নতুন কূপ খনন করে গ্যাস অনুসন্ধান চালিয়ে যেতে হবে। দেশে বিদ্যুৎ প্রয়োজন অনেক বেড়ে যাওয়ার কারণে নিউক্লিয়ার শক্তিকেন্দ্র স্থাপন করা সম্ভাব্য সমাধান হিসেবে বিবেচনা করা যায়।